হিজাব কখন পর্দা হয়

পর্দা ফরজ হুকুম জানার পরে নতুন দ্বীনে ফেরা বোনদের মাথায় জেঁকে বসে পর্দা করার সাধ।
পর্দা করো, পর্দা করো বলে বেড়ানো, বোনেরা যদি হাতে কলমে তাদের শিখিয়ে না দেই তবে নতুনেরা শিখবে কাদের কাছে?

পর্দা ফরজ, এতটুকু বলেই আমাদের দ্বায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আমাদের তরুণ প্রজন্মের জন্য নিজেদেরই অনেককিছু করা বাকি। আজ তাদেরকে সঠিকটুকু না ধরিয়ে দিলে, কাল বেঠিকটুকু অন্যরা ঠিকই ধরিয়ে দিবেন। তখন আফসোসের বন্যা বইয়ে দিলেও তথাকথিত হিজাবের ফাঁক ফোকরে পর্দার সংজ্ঞা আর প্রবেশ করবে না।

তাদের কর্ণকুহরে সত্যটুকু পৌঁছে দিয়ে আমাদের নিজেদের দ্বায়িত্বটুকু পালন করবো। আল্লাহ চাইলে, তারা নিজেরাই নিজেদের বিবেকের উত্তম প্রয়োগে হয়ে যেতে পারেন আমাদের কাছে অনুকরণীয়।

সরাসরি আজকের মূল প্রসঙ্গে চলে যাই।
তো, যেখানে ছিলাম। পর্দা ফরজ হুকুম জেনে আমাদের কোমলমতি বোনেরা ছুটে যান রঙ বেরঙের বাহারি কালেকশন এর হিজাবের দোকানগুলোয়।
চোখ ধাধানো সুন্দর কাপড়ের ভিড়ে কয়েকটি হিজাব তারা বেছে নেন নিজের পছন্দসই।

এরপর চলে যান কালারফুল সুন্দর সুন্দর বোরকার কালেকশন দেখতে। আমি নিজেও প্রথম পর্দা শুরু করার সময়ে বিভিন্ন ফেইসবুক পেইজের সুন্দর সুন্দর বোরকার কালেকশন দেখতাম। সুন্দর বোরকা দেখা দোষের কিছু না। মেয়ে মানুষের মন তো! সুন্দরকে একটু বেশিই টানে।

বিপত্তি বাধে কখন জানেন?
যখন তথাকথিত হিজাব-আবায়াতে নতুন পর্দা করা বোনকে আরও বেশি আকর্ষণীয় লাগে! চুল খুলে ঘুরতে বের হওয়া মেয়েটা যখন দেখে হিজাবে তাকে আরও বেশি সুন্দর লাগছে। তখন ভিউ বাড়ে ইউটিউব এ স্টাইলিশ হিজাব টিউটোরিয়ালগুলোর।

দিনে দিনে মাথায় বসে যায় যে হিজাব করতে হবে।
হিজাব বলতে আসলে কতটুকু বোঝায়, হিজাব কি?
তার সঠিক জ্ঞানের অভাবে আমার হৃদয়ের টুকরোরা ভুল পথে পা বাড়ান। নিজেদের ভাবেন পর্দানশীন, অথচ তারা ভুল কনসেপ্ট বয়ে বেড়িয়ে নিজের অজান্তেই হন বেপর্দা নারীদের মতোই।

হিজাবের কিছু বেঠিক উদাহরণ:

১. শাড়ির সঙ্গে হিজাব, টাইট ফিটিং ড্রেসের সাথে হিজাব,জিন্সের সাথে হিজাব, টপসের সাথে হিজাব।
এতো এতো হিজাব দেখে দেখে আমাদের বোনেরা শিখে হিজাব মানে চুল ঢেকে চলা। টু বি অনেস্ট, শতকরা ৫০% মেয়ে নিজেদের চুল ধুলোবালি থেকে রক্ষা করতে হিজাব পড়ে।

২. দুই স্তর, তিন স্তর বিশিষ্ট সিড়ি সুলভ হিজাবের স্টাইলে চাপা পড়ে যায় আসল হিজাবের ধারণা। হিজাব লিখে সার্চ দিলেও বাহারি স্টাইলের হিজাব টিউটোরিয়াল দেখে এই তরুণীরা হিজাব মানেই ফ্যাশন সচেতনতা বোঝে।

৩. ফ্যাশন হাউজ গুলোর দিকে যদি তাকাই, তবে দেখা মেলে এক আধ্যাত্মিক কনসেপ্ট, যেখানে বলা হয়,” চুল ঢেকে সব করতে পারে নারী। নারী অবহেলিত নয়। নারী হিজাবেও সুন্দরী ও অনন্যা ”
—এই কনসেপ্ট দিয়ে পর্দার নামে পর্দালঙ্ঘনের অপপ্রয়াস চলে।

৪. হিজাব করা নারীদের মাঝের পরিবর্তনটা সবার আগে টের পায় ফেইসবুক। মনের ভাবটুকুর সবটাই তো আগে আসে ফেইসবুকে। তেমনি হিজাব পড়া সবচেয়ে সুন্দর দেখতে ছবিখানা আপলোড দিয়ে কমেন্ট সেকশনে মাশা আল্লাহ দেখেই বোনেরা নিশ্চিত হয়ে যান যে, তারা হিজাবি! ক্যাপশনে লিখেন, “Hijab is my Pride”।
বাহ! কি চমৎকার!

৫. হিজাব শুধুমাত্র পার্সোনাল প্রোফাইলে সীমাবদ্ধ থাকে না। গার্লস গ্রুপগুলোতে চলে মেইকআপ করা হিজাবি বোনদের প্রতিযোগিতা। তাদের সুন্দর টানা টানা চোখ দেখে, পর্দা করতে চাওয়া বোনগুলি হতে চান তাদের মতো। তারা ভাবেন, ইশ! আপুরা কত সুন্দর ইসলাম মেনে চলেন। হিজাব করে গ্রুপের আপুদের মতো হতে চাওয়া ফ্যান্টাসিতে রসাতলে যায় পর্দার কনসেপ্ট!

৬. হিজাব করেও রিলেশনশিপ এ যুক্ত থাকা বর্তমানে একটা ট্রেন্ড। রিলেশনশিপ নিয়ে অনেক লিখেছি। দরকার হয় আবার লিখবো। স্বল্প পরিসরে এই নিয়ে লেখা আসলে মাথায় ঢুকবে না। এর জন্য পর্যাপ্ত আলোচনা প্রয়োজন। ইন শা আল্লাহ, আল্লাহ তৌফিক দিলে বিস্তারিত জানাবো। আপাতত কেবল এতটুকু জেনে রাখুন— বিয়ে বহির্ভূত প্রেম হারাম। হারাম মানে হারাম, হিজাব পড়েও হারাম। হিজাব না পড়েও হারাম। হিজাব পড়ে প্রেম করলে তা হালাল হয়ে যায় না।

এরপর চাইলে আরও বেঠিক উদাহরনের বন্যা বইয়ে দিতে পারি। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য এই বোনদের কটাক্ষ করা নয়। এনারা নিজেরাও জানেন না পর্দা কি! জানলে কি আর নিজেদের জন্য খাল কেটে কুমির আনতেন? আমার উদ্দেশ্য কনসেপ্ট ধরিয়ে দেয়া। আমার মাঝেও ভুল থাকবে স্বাভাবিক, কিন্তু শেখার মানসিকতা নিয়ে আগাবো!

চলুন এবার একটু পর্দার সঠিক কনসেপ্ট এর দিকে চলে যাই:

১. পর্দা হবে এমন যাতে পুরো শরীর ঢাকে। এটাই নারীর হিজাব। চুল ঢেকে চলাচল করাই হিজাব নয়। হিজাবের সংজ্ঞা আরও বিস্তৃত ও সুষমাময়। যা কিছু সুন্দর তা কুদৃষ্টি হতে বাঁচাও কনসেপ্ট থেকে আসা এই হিজাবের প্রকৃত উদ্দেশ্য। এর মানে সৌন্দর্যকে দমিয়ে রাখা নয়৷ সৌন্দর্য ও কুদৃষ্টির মাঝে প্রতিরক্ষা বেষ্টনী গড়ে তোলাই হিজাবের কাজ।

২. হিজাব হবে সৌন্দর্যকে বদনজরের হাত থেকে বাঁচানোর মাধ্যম। হিজাব করে যদি দেখতে আরও বেশি আকর্ষণীয় লাগে। তবে পর্দার শর্ত সমূহ আবার পড়া উচিত। বারবার সময় নিয়ে পড়া দরকার। হিজাব যেন নিজেই সাজসজ্জা হয়ে না যায় তাতে কড়া নজরদারি প্রয়োজন। উদাহরণঃ গর্জিয়াস কাজের আবায়া, বোরকা,কালারফুল হিজাব, ইত্যাদি ইত্যাদি ও ইত্যাদি।

৩. হিজাবের কাপড় হবে পুরু, যাতে কাপড়ের বাহির থেকে ভেতরের মানুষের শরীরের অবয়ব ফুটে না ওঠে। অর্থাৎ কাপড়ের ধরন হবে এমন যাতে অনায়াসেই দেহের রং বোঝা না যায়, চিকন না মোটা বোঝার উপায় না থাকে।

৪. ঢিলেঢালা বোরকা পড়তে হবে, প্রকৃতপক্ষে হিজাব করতে চাইলে। আর যদি ফ্যাশন সচেতনতা মূল উদ্দেশ্য হয় তবে যা ইচ্ছে পড়ুন। সেটাকে পর্দা নাম না দিয়ে অন্য যা খুশি বলুন।
যাই হোক, কথা হচ্ছে বোরকা আঁটোসাটো হবে না, গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকবে না, মোটা না চিকন তা বোঝা যাবে না। ঢিলেঢালা বোরকার ফিতা বেধে চলাচল করলে তাতে শরীরের আকার আকৃতি বোঝা যায়। অর্থাৎ, ফিতা বেধে চলাচল করা যাবে না।

৫. সুগন্ধি ব্যবহার করা নারীর জন্য হারাম পর্যায়ের, স্বামীর সামনে সুগন্ধি ব্যবহার করা যায়। কেন হারাম তা জিজ্ঞেস করলে বলবো,
—সুগন্ধি ব্যবহার করা নারী যখন বাহিরে চলাচল করে। তখন সেই সুগন্ধির জন্য হলেও পরপুরুষ একবারের জন্য হলেও তার দিকে তাকাবে। না তাকালেও সুগন্ধি নিতে তাদের ভালো লাগবে। তাই একজন মুমিন নারী নিজের সুগন্ধিও পর পুরুষকে বিলিয়ে বেড়াবে না। তাই বোরকা পড়েও সুগন্ধি ব্যবহার করলে যেই লাউ সেই কদুই রয়ে যাবে।
Say No, to perfume!
প্রথম প্রথম অস্বস্তি লাগলেও পরে ঠিক হয়ে যায়।

৬. জিন্সের উপর হিজাব নয়, টপ্সের উপর হিজাব নয়, শাড়ির সাথেও হিজাব নয়। মেইকআপের সাথেও হিজাব পড়ে মুখ খোলা রেখে চলা নয়। নিকাব পড়ে চোখে আইলাইনার ব্যবহার করে চোখ সাজানো নয়।
এসব নয় কে আপন করে নিতে পারলেই হিজাব হয়ে যাবে পর্দার উপযুক্ত উপকরণ।
নতুবা এসব হিজাব মানেই পর্দা নয়।

৭. হিজাব তারকাদের ফ্যাশনের সদৃশ হবে না, অবিশ্বাসী নারীরাও চুল ঢেকে চলে। তারাও আকর্ষণীয় বোরকা পড়ে ফটোশুট করে।
আবার অন্য ফ্যাশন এলে সেটাও মেইনটেইন করে। মুমিন নারীর পর্দা দেখে ফ্যাশন মনে হবে না। হবে না, মানে হবেই না।

৮. লোকদেখানো পর্দার নিয়ত রাখলে সেই পর্দা করার ফজিলতঃ মাশা আল্লাহ, মেয়েটা পর্দানশীন, ও পর্দা মেইনটেইন করে চলে!
— ব্যাস এতটুকুই।
আল্লাহর কাছে এই পর্দা করে ফজিলত চাওয়া বোকামি। আমি পর্দানশীন নারী, বোঝানোর জন্য পর্দা করলে, আপা আপনার পর্দা করার শর্তগুলো মুখস্থ করে নেয়া উচিত। আপনার আশেপাশের মানুষ সত্যিকারের পর্দা করতে চাইলে তারা করবে আপনার আচরণে। আপনাকে পর্দায় সুন্দর ও ভদ্র মনে হয় এইজন্য না।
যদি দাওয়াত দিতেই চান,তবে লিখুন, এরপর লিখুন, আবার লিখুন। প্রয়োজনে বোনদের সঙ্গে কথা বলুন। রেফারেন্স দিন,পর্দার আয়াত দেখান, তাফসীর পড়তে দিন। তবুও প্রথম দাওয়াত যেন আপনার বোরকা পড়া ফুটফুটে ছবিটি যেন না হয়।

প্রোফাইলে সুন্দর পর্দা করা ছবি দিয়ে আপনার পর্দার মানক্ষুন্ন করবেন না। আল্লাহর জন্য করা পর্দাকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই রাখুন। লোকে দেখে কিছু বলুক সেই আশায় পর্দা করবেন না প্লিজ।

সর্বশেষঃ যা কিছু বলেছি, বানিয়ে কিছু বলিনি। তবুও এতে ভুলত্রুটি থাকবে তাতে কোনই সন্দেহ নেই। আল্লাহর কাছেই এই দাওয়াতের বিনিময় ও অনুগ্রহ কামনা করে আজকের আলোচনাকে এই পর্যন্তই যথেষ্ট মনে করছি। যদি আপনার দৃষ্টিতে আমার কোন ভুল ধরা পরে নির্দিধায় জানিয়ে দিন। ভুল সংশোধনে আমি সন্তুষ্টচিত্তে এগিয়ে যাবো। লেখার ভাব ভঙ্গিতে কোথাও যদি কাঠিন্য খুঁজে পান, তবে জেনে রাখুন সেটা আমার লৈখিক ত্রুটি। শব্দচয়ণের সীমাবদ্ধতায় যদি আমার আন্তরিকতা হারিয়ে যায়, তবে এই বাক্যটুকুর জন্য হলেও আমার আন্তরিক ভালোবাসা গ্রহণ করুন বোনেরা।

এখানেই শেষ নয়,এই নিয়েই আরও কিছু বলা বাকি।
ইন শা আল্লাহ, পরবর্তী আলোচনায় আপনাদের আমন্ত্রণ রইলো।

শুভকামনা,
সুস্থ ও সুন্দর থাকুন।
পর্দাকে কেবল জানালায় নয়, নিজের সৌন্দর্য কুদৃষ্টি থেকে বাঁচাতে ব্যবহার করুন।

লেখিকা:
আলিজা বিনতে আব্দুল কাদের

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *