মুমিনের কাঙ্খিত রমযান মাসের পূর্ববর্তী মাসের নাম শাবান। দ্বীনী বিবেচনায় এই মাসটি অত্যন্ত তাৎপর্য ধারণ করে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুরুত্বের সাথে এ মাসে আমল করতেন।
নবীজী যে মাসে বেশি বেশি রোযা রাখতেন
শাবান মাস এলে নবীজী অধিকহারে রোযা রাখতেন। আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন,
مَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ اسْتَكْمَلَ صِيَامَ شَهْرٍ قَطّ إِلاّ رَمَضَانَ وَمَا رَأَيْتُهُ فِي شَهْرٍ أَكْثَرَ مِنْهُ صِيَامًا فِي شَعْبَانَ.
‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ব্যতীত পূর্ণ মাস রোযা রাখতে দেখিনি। আর শাবান মাস অপেক্ষা অন্য মাসে অধিক রোযা রাখতে তাঁকে দেখিনি’। [সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯১]
হযরত আয়েশা রা. আরো বলেন,
كَانَ أَحَبّ الشّهُورِ إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَنْ يَصُومَهُ شَعْبَانَ…
‘অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট প্রিয় আমল ছিল শাবান মাসে রোযা রাখা…’। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৫৫৪৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৩১]
ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রাহ. বলেন, ফরয নামাযের আগে-পরে যেভাবে সুন্নত-নফলের বিধান রয়েছে, তেমনি রমযানের আগে-পরে শাবান ও শাওয়াল মাসে রোযার বিধান রয়েছে মূল বিধানের পরিপূরক হিসাবে। তাই মূল ইবাদতের পাশাপাশি পূর্বাপরের নফল ইবাদতগুলোর প্রতিও যত্নবান হওয়া চাই। (দ্রষ্টব্য : লাতায়েফুল মাআরেফ, পৃ. ১৮৮)
এ হিসাবে পয়লা শাবান থেকে সাতাশ শাবান পর্যন্ত রোযা রাখার বেশ গুরুত্ব রয়েছে। হাদীস শরীফে শাবানের শেষ দুয়েকদিন রোযা রাখতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে রমযানের প্রস্তুতি নেওয়ার লক্ষে। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯১৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৮২)
লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান : ফযীলতপূর্ণ এক রজনী
অর্ধ শাবানের রজনী তথা চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতের রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য। হাদীসের ভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’। প্রচলিত ভাষায় আমরা যাকে ‘শবে বরাত’ বলে ব্যক্ত করি। হাদীসে এ রাতের বিশেষ ফযীলতের বিবরণ এসেছে।
হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
يَطْلُعُ اللهُ إِلَى خَلْقِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلّا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ.
‘অর্ধ শাবানের রাতে আল্লাহ সৃষ্টির প্রতি (রহমতের বিশেষ) দৃষ্টি প্রদান করেন। অতঃপর শিরককারী ও বিদ্বেষপোষণকারী ছাড়া সমগ্র সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন’। [সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৬৬৫]
এছাড়া আরো বহু হাদীসে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বা শবে বরাতের কথা এসেছে। সুতরাং এটি একটি ফযীলতপূর্ণ রজনী।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেছেন,
‘পনেরো শাবানের রাতের ফযীলত সর্ম্পকে একাধিক ‘মারফু’ হাদীস ও ‘আসারে সাহাবা’ বর্ণিত রয়েছে। এগুলো দ্বারা ওই রাতের ফযীলত ও মর্যাদা প্রমাণিত হয়। সালাফে সালেহীনের কেউ কেউ এ রাতে নফল নামাযের ব্যাপারে যত্নবান হতেন। আর শাবানের রোযার ব্যাপারে তো সহীহ হাদীসসমূহই রয়েছে।
‘কোনো কোনো আলেম যদিও এই রাতের ফযীলত অস্বীকার করেন; কিন্তু হাম্বলী ও গায়রে হাম্বলী অধিকাংশ আলেমই এই রাতের ফযীলতের কথা স্বীকার করে থাকেন। ইমাম আহমাদ রাহ.-এর মতও তাই। কেননা এর ফযীলত সম্পর্কে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে এবং এগুলোর সমর্থনে সালাফ (সাহাবী ও তাবেয়ী)-এর ‘আসার’ও বিদ্যমান আছে; যেগুলো ‘সুনান’ ও ‘মুসনাদ’ শিরোনামে সংকলিত হাদীসের কিতাবে [বরং কতক ‘সহীহ’ শিরোনামের কিতাবেও যেমন সহীহ ইবনে খুযাইমা (কিতাবুত তাওহীদ), সহীহ ইবনে হিব্বান প্রভৃতিতে] রয়েছে। যদিও এ ব্যাপারে বহু বিষয় জালও করা হয়েছে। [ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকীম ২/১৩৬, ১৩৭]
এ রাতের আমল সম্পর্কে ‘শুআবুল ঈমান’ বায়হাকীর নিম্নোক্ত হাদীসটি লক্ষ করুন।
হযরত আলা ইবনুল হারিছ রাহ. থেকে বর্ণিত, হযরত আয়েশা রা. বলেন,
قَامَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ مِنَ اللّيْلِ يُصَلِّي فَأَطَالَ السّجُودَ حَتّى ظَنَنْتُ أَنّهُ قَدْ قُبِضَ، فَلَمّا رَأَيْتُ ذَلِكَ قُمْتُ حَتّى حَرّكْتُ إِبْهَامَهُ فَتَحَرّكَ، فَرَجَعْتُ، فَلَمّا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنَ السّجُودِ، وَفَرَغَ مِنْ صَلَاتِهِ، قَالَ: يَا عَائِشَةُ أَوْ يَا حُمَيْرَاءُ ظَنَنْتِ أَنّ النّبِيّ خَاسَ بِكِ؟ ، قُلْتُ: لَا وَاللهِ يَا رَسُولَ اللهِ وَلَكِنِّي ظَنَنْتُ أَنّكَ قُبِضْتَ لِطُولِ سُجُودِكَ، فَقَالَ: أَتَدْرِينَ أَيّ لَيْلَةٍ هَذِهِ؟ ، قُلْتُ: اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: هَذِهِ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، إِنّ اللهَ عَزّ وَجَلّ يَطْلُعُ عَلَى عِبَادِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِلْمُسْتَغْفِرِينَ، وَيَرْحَمُ الْمُسْتَرْحِمِينَ، وَيُؤَخِّرُ أَهْلَ الْحِقْدِ كَمَا هُمْ.
‘একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সিজদা করেন যে, আমার ধারণা হল, তিনি হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা, অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা! তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম আল্লাহর কসম, না, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না। নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন্ রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন এটা হল অর্ধ-শাবানের রাত। (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত।) আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তাঁর বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’ [শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৩৫৫৪]
ইমাম বাইহাকী রাহ. এই হাদীসটি বর্ণনা করার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেন,
هذا مرسل جيد
হাদীস শরীফের বর্ণনা থেকে এ রাতের আমলের ব্যাপারে যতটুকু পাওয়া যায় তা হচ্ছে এ রাতে বিশেষভাবে তওবা-ইস্তিগফার, দুআ-রোনাযারী এবং নফল ইবাদতে মশগুল থাকা। একা একা যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব সাধারণ নফল ইবাদতে মনোযোগী হওয়া। যিকির-তাসবীহ পড়া, দুআ-দরূদ পড়া, লম্বা লম্বা রুকূ-সিজদায় নফল পড়া, কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা ইত্যাদি। এ পরিমাণ ইবাদত করা, যাতে এর দ্বারা ফরয আমলে ব্যাঘাত না ঘটে। এমন যেন না হয়, সারারাত নফলে মশগুল থেকে ফজরের জামাত ছুটে গেল বা কাযা হয়ে গেল।
তেমনি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। বিশেষ করে ওইসব গুনাহ এবং নাফরমানি থেকে গুরুত্বের সাথে বেঁচে থাকা যেগুলো এ রাতের সাধারণ ক্ষমা থেকে বঞ্চিত করে দেয়।
এছাড়া নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ রাতকে ঘিরে বিশেষ কোনো আমলের ব্যাপারে বিশেষ কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। সম্মিলিত ইবাদত, নির্দিষ্ট সূরা দিয়ে বিশেষ নামায, সম্মিলিত মীলাদ-মাহফিল, শবীনা খতম ইত্যাদি যেসকল রেওয়াজ কোনো কোনো সমাজে প্রচলিত রয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
শাবানের পনের তারিখের রোযা
হযরত আলী ইবনে আবি তালেব রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، فَقُومُوا لَيْلَهَا وَصُومُوا نَهَارَهَا، فَإِنّ اللهَ يَنْزِلُ فِيهَا لِغُرُوبِ الشّمْسِ إِلَى سَمَاءِ الدّنْيَا، فَيَقُولُ: أَلَا مِنْ مُسْتَغْفِرٍ لِي فَأَغْفِرَ لَهُ أَلَا مُسْتَرْزِقٌ فَأَرْزُقَهُ أَلَا مُبْتَلًى فَأُعَافِيَهُ أَلَا كَذَا أَلَا كَذَا، حَتّى يَطْلُعَ الْفَجْرُ.
‘পনের শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোযা রাখ। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, আছে কি কোনো ক্ষমাপ্রার্থী? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোনো রিযিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দেব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৮৮]
ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রাহ. বলেন, শাবানের পনের তারিখে রোযা রাখা নিষিদ্ধ নয়। কেননা এই পনের তারিখ তো আইয়ামে বীযেরই (প্রত্যেক আরবী মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ) একটি দিন, হাদীস শরীফে যে দিনগুলোতে রোযা রাখার কথা এসেছে। এছাড়া এ দিনে রোযা রাখার ব্যাপারে সুনানে ইবনে মাজাতে হযরত আলী ইবনে আবী তালেব রা. থেকে বর্ণিত স্বতন্ত্র হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। যদিও তার সনদ দুর্বল। [লাতায়েফুল মাআরেফ, পৃ. ১৯৭]
তো একদিকে নবীজী শাবান মাসে রোযা রাখার বিশেষ এহতেমাম করতেন, পাশাপাশি শাবানের পনের তারিখ আইয়ামে বীযেরও একটি দিন। অতএব কেউ যদি এই বিবেচনায় শাবানের পনের তারিখে রোযা রাখে তাহলে ইনশাআল্লাহ মাহরূম হবে না। তবে সম্ভব হলে আইয়ামে বীযের তিন দিনই (চাঁদের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ) নফল রোযা রাখতে পারলে সবচে উত্তম হয়।
শবে বরাত : ভারসাম্য রক্ষা করি
শবে বরাতকে ঘিরে আমাদের সমাজে রয়েছে দ্বিমুখী প্রান্তিকতা। কেউ কেউ শবে বরাতের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করতে চান, যা একদমই অনুচিত। তাদের জন্য আশা করি উপরোক্ত হাদীসের বিবরণ যথার্থ হবে। আর কোথাও কোথাও এ রাতকে ঘিরে রয়েছে নানা ধরনের রসম-রেওয়াজ এবং বিভিন্ন গর্হিত কর্মকাণ্ড, যা সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য।
শবে বরাত উপলক্ষে খিচুরি হালুয়ার রুসম, পটকা-আতশবাজির সংস্কৃতি, দোকান-পাট, ঘর বাড়ি, এমনকি মসজিদ আলোকসজ্জা করা, বিভিন্ন মেলার আয়োজন করা, কবরস্তান ও মাজারে মাজারে ভিড় জমানোর রেওয়াজ। কিশোর-যুবকদের দলবেঁধে ঘুরাঘুরি করার প্রবণতা। মাজারে এবং মেলায় নারীদের ভিড় জমানো ইত্যাদি যে প্রচলন রয়েছে তা অত্যন্ত আপত্তিকর। এগুলোর কিছু কিছু তো সম্পূর্ণ হারাম এবং নাজায়েয। আর কিছু কিছু রয়েছে, যা সাধারণ অবস্থায় বৈধ হলেও (যেমন হালুয়া রুটি খাওয়া এবং খাওয়ানো) শবে বরাতের আমল মনে করা বিদআত। অতএব এসবে সময় নষ্ট না করে বিশেষ সময়ের বিশেষ কদর করা চাই। দীর্ঘ দীর্ঘ আমল করা সম্ভব না হলে অন্তত এশা ও ফজর নামায জামাতে পড়ার চেষ্টা করি এবং যতটুকু পারি নফল আমল করি। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে অহেতুক বিতর্কে জড়িয়ে কিংবা নানা রসম রেওয়াজে লিপ্ত হয়ে নিজের দ্বীনী ও ঈমানী ক্ষতি করা মোটেও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়।
আল্লাহ আমাদের সঠিক উপলব্ধির তৌফিক দান করুন