পর্দা সমাচার

আমাদের চারপাশে বর্তমানে একটা চোখে পড়ার মত পরিবর্তন হলো- বোরখা পরিধেয় নারীর সংখ্যা আগের তুলনায় ব্যাপক হারে বেড়েছে। কিন্তু পর্দানশীল নারীর সংখ্যা কি সত্যিই বেড়েছে???

চলুন একটু অস্ত্রপচার চালানো যাক বর্তমানের এ দৃশ্যমান পরিবর্তনটির।

||| অভিজ্ঞতা ১ |||

তার ছদ্মনাম ধরলাম শিউলি।।।
শিউলি কিন্তু বোরখা পরে না। ঢিলেঢালা কামিজ পরে সে। এমনকি কামিজ সিলেকশনের ক্ষেত্রেও সে গায়রে মাহরামের সামনে অাসার সময় অনুজ্জ্বল রঙের, সাধাসিধে কামিজটি বেছে নেয়। এরপরও কোমড়ের মাপ যাতে কেউ সহজে বুঝতে না পারে, তাই কামিজের উপর একটি লং কোটিও পরে শিউলি। পা খালি খালি লাগে বলে পা মোজাও কিনেছে শিউলি সেদিন। তার চোখেমুখে একটা পরিতৃপ্তি দেখেছি সেদিন, প্রথম যেদিন পা মোজা পরে ক্যাম্পাসে এসেছিল সে। ক’দিন অাগে ক্যাম্পাসে একটি গোলাপি রঙের নতুন কামিজ পরে এসেছিল শিউলি। কয়েকজন তার ড্রেসের প্রশংসা করায় আর কোনদিন এটা পরে বাইরে বের হবে না বলে সেদিনই ঠিক করে নিয়েছে সে। উজ্জ্বল রঙে নাকি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সে, এটা ছিল তার যুক্তি আর পরিতাপের কারণ। অথচ আমরা নারীরা স্বভাবতই প্রশংসার নেশার মত্ত। কোভিডের ভয়ে মাস্ক পরতে পরতে নিকাবের অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে ভেবেও উচ্ছ্বসিত সে। মোটকথা শিউলির পোশাক-আশাক, আচার-আচরণে পুরুষের সামনে নিজের সৌন্দর্য আড়াল করার একটা চেষ্টা স্পষ্ট।
বাজারে বোরখা কিনতে গিয়েও ফিরে এসেছিল সে এই ভেবে যে দোকানের রেডিমেইড, বাহারি ডিজাইনের বোরখাগুলো তার বডিশেইপ কাভার করতে পারবে না পারফেক্টলি। এরপরও শিউলির অসন্তোষের কারণ এই যে, তার মতে সে শালীনতা মেইনটেইন করতে পারলেও পর্দা হয়তো মেইনটেইন করতে পারছে না। এই আফসোস নিয়েও বেশিদিন থাকতে পারে নি সে। এই ঈদে কাপড় কিনে নিজের মন মতো ঢিলেঢালা, সাধাসিধে একটি বোরখা সে বানিয়ে নিবে বলে নিয়্যাত করেছে।

||| অভিজ্ঞতা ২ |||

ছদ্মনাম বকুল।।।
বকুল খিমার পরে। খিমার কেনার সময় বকুলের প্রায়োরিটি ছিলো দোকানের সবচেয়ে অাকর্ষণীয় রঙটি। তাছাড়া খিমারই তো এখন ট্রেন্ডি বোরখা। নিকাব করলেও কাজল, লাইনার দিয়ে চোখকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে বকুল। অার তার ফরসা পা দুটোও খিমারের নিচ দিয়ে চকচক করে। অার হ্যা, খিমারটি বকুলকে তার বয়ফ্রেন্ড গিফট করেছে। দুজন একসাথে গিয়ে কিনে এনেছিলো সেদিন ওটা। বিভিন্ন অনলাইন পেইজের সব আকর্ষণীয় বোরখাগুলোর স্ক্রিনশটে বকুলের গ্যালারি ভরপুর। এদিকে ফ্রেন্ড সার্কেলের সকলের বকুলকে ছাড়া চলেই না। ভারী মিষ্টি গানের গলা তার। সন্ধ্যায় টঙে বসে চা, গীটার আর বকুলের গান, এটা ওদের ক’জনের রোজনামচা। ক্ষতি কী? সে তো বোরখা পরেই সব করছে- এটা বকুলের যুক্তি। নিজেকে পর্দানশীল বলেই দাবী করে সে।

||| অভিজ্ঞতা ৩ |||

ছদ্মনাম লিলি।।।
লিলি চাকুরিজীবী নারী। রোজ রোজ বাইরে পরার জন্য ভালো মানের ইস্ত্রি করা ড্রেস মেইনটেইন করা বেশ ঝামেলার কাজ। এর চেয়ে বোরখা পরাই সুবিধাজনক। দুইটা দিয়েই বছর কেটে যায়। ঝামেলা নাই। আবার পর্দাও হলো।
লিলিদের যৌথ পরিবার। দেবরকে সে ছোট ভাইয়ের মতই দেখে। গালে তুলে খাইয়েও দেয় (যদিও স্বামী মারা গেলে এই দেওরকে বিয়ে করা তার জন্য জায়েজ)। সামনের মাসে লিলিরা তিনজন (দেবরসহ স্বামী স্ত্রী দুজন) কিছু কাজিনসহ সাজেক ঘুরতে যাবে। একটু ছুটি পেলেই মাঝে মাঝেই এভাবে সবাই মিলে কোথাও ঘুরে আসা হয়। লিলি খুবই মিশুক স্বভাবের। গায়রে মাহরাম কাজিন, দেবর, দুলাভাইয়ের সাথে একদম মিশে যাওয়াকে প্রশংসনীয় আচরণ বলে মনে করে লিলি। যারা এগুলো নিয়ে কিছু বলতে আসে, তারা ‘সংকীর্ণমনা’ উপাধি পায় লিলির কাছ থেকে। লিলির ধারণা, ‘মন ঠিক, তো জগৎ ঠিক’।

………………………

এবার আসুন, পর্দা সংক্রান্ত সূরা আন-নূরের ৩১ নম্বর আয়াতটি একবার পড়া যাক-

❝ঈমান আনয়নকারিনী নারীদেরকে বলঃ তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান তা ব্যতীত তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে। তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে। তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভাই, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নীপুত্র, আপন নারীগণ, তাদের মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌন কামনা রহিত পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারও নিকট তাদের আভরণ প্রকাশ না করে। তারা যেন তাদের গোপন আভরণ প্রকাশের উদ্দেশে সজোরে পদক্ষেপ না ফেলে। হে মু’মিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।❞ [১]

লক্ষণীয়, উক্ত আয়াতে নারীদের দৃষ্টি সংযত রাখতে বলা হয়েছে। তার মানে, দৃষ্টির হেফাজত করাও পর্দার আওতায় পড়বে, যাকে চোখের পর্দা বলা হয়।

এবার সূরা আহযাবের ৩২ নম্বর আয়াতের দিকে দৃষ্টি দেই-

❝হে নবী-পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলো না, যাতে অন্তরে যার ব্যাধি আছে সে প্রলুব্ধ হয়। আর তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে।❞

তাফসীরকারকগণের মতে, এ সব নির্দেশাবলীতে সম্বোধন যদিও রাসূল (স)-এর পবিত্রা স্ত্রীগণকে করা হয়েছে, তবুও বর্ণনা ভঙ্গীতে প্রকাশ পাচ্ছে যে, উদ্দেশ্য সমগ্র মুসলিম নারীকে বোঝানো ও সতর্ক করা। অতএব উক্ত নির্দেশাবলী সমগ্র মুসলিম নারীর জন্য মান্য ও পালনীয়।

উক্ত আয়াতে কণ্ঠের পর্দার নির্দেশটিও স্পষ্ট। তার মানে দাড়াচ্ছে, কণ্ঠও পর্দার অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হবে।

এখন আসি, আমাদের অনেক বোনেরা দাবী করেন, তখনকার পরিবেশ আর এখনকার পরিবেশ আলাদা। এখন আমাদের লেখাপড়া, চাকরি এসকল বিভিন্ন কারণে পুরুষের সাথে মিশতেই হবে।

তাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা, কুরআন, সুন্নাহ, ফিকহ, আহকাম এসকল বিষয়ে আয়শা (রা) এর মত পারদর্শী এবং জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব আর একজনও ছিলেন না। তিনি শিক্ষাবিস্তারের জন্য শুধু যে মসজিদে নববীতে সময় দিয়েছেন তা নয়, দূর দূরান্তেও পাড়ি দিয়েছেন। তার দেশ বিদেশের অগণিত শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত সুচারুরূপে জ্ঞানার্জন করেছেন তাঁর কাছ থেকে। তিনি কি পর্দা মেইনটেইন করেননি?

আমার কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য এটা বোঝানো যে, পর্দা মানে কোন নির্দিষ্ট নামধারী পোশাক শুধুমাত্র বাড়ির বাইরে যাবার সময় গায়ে জড়ানো নয়। যদি আমার বেডরুমেও উল্লেখিত [১] ১৪ প্রকার মাহরাম পুরুষ ব্যতীত কোন গায়রে মাহরাম উপস্থিত থাকে, তবে নিজের বেডরুমেও আমাকে পোশাকের পর্দা, চোখের পর্দা, কণ্ঠের পর্দা মানতে হবে।
অথচ, পাশের বাড়িতে অনেক গায়রে মাহরাম থাকার পরও শুধুমাত্র মাথায় ওড়নার কিয়দাংশ দিয়ে প্রবেশ করাকে আমরা স্বাভাবিক মনে করি। যুক্তি? এখান থেকে এখানে, বোরখা পরা লাগে নাকি?

প্রকৃতপক্ষে পর্দা কাকে বলে বোনেরা?
নারী পুরুষ উভয়ে চারিত্রিক পবিত্রতা অর্জনের নিমিত্তে উভয়ের মাঝে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত যে আড়াল বা আবরণ রয়েছে তাকে পর্দা বলে।

কাজেই আমি বোরখা পরে ছেলেবন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বেড়ালে সেটা পর্দা নয়। পর্দা হতে হবে আমার পোশাকের, আমার চোখের, আমার কানের, আমার কণ্ঠের, আমার মনের।

তবে যারা হয়তো একবারেই নিজেকে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করতে পারছেন না, হিজাব দিয়ে, বা বোরখা দিয়ে শুরু করেছেন একটু একটু করে, তাদের নিরুৎসাহিত করছি না। আপনি চেষ্টা শুরু করেছেন, তাই আপনাকে সাধুবাদ। আল্লাহর জন্য আপনি এক কদম এগিয়েছেন মানে ধীরে ধীরে বাকি রাস্তা আল্লাহই দেখিয়ে দেবেন। তবে মন থেকে আল্লাহর ভয়ে এই পরিবর্তনের চেষ্টা টা সহীহ হতে হবে। তাহলেই শিউলির মত নিজের ইবাদত (পর্দা) নিয়ে অসন্তুষ্টি, নিজের রূপ লাবণ্যকে পুরুষ থেকে আড়াল করার ইচ্ছা আপনাকে একদিন পরিপূর্ণ পর্দানশীল করে তুলবে ইনশাআল্লাহ। অন্যদিকে বকুল আর লিলির মত পর্দার সঠিক সংজ্ঞা না জেনেই আত্নতুষ্টিতে ভুগলে শেষ বিচারের দিন হিসাব মেলাতে গিয়ে হয়তো দেখতে হবে, বোরখা পরেও পর্দার কোন আমলই আপনার আমলনামায় জমা পড়ে নি।

তাই বোন, আমাদের লক্ষ্য যেন থাকে তথাকথিত বোরখাওয়ালি হওয়া নয়, প্রকৃত পর্দাওয়ালী হতে পারা।

লেখক:
–ফৌজিয়া তাবাসসুম মিম্মা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *